টিএ ও ডিএ দেরি করে দিলে কোম্পানির ক্ষতি কি? Why it is harmful for a company if they give TADA late



প্রশ্ন : বাংলাদেশের অনেক সুপরিচিত কোম্পানি কর্মীদের টিএ ও ডিএ দিতে ইচ্ছেকৃতভাবে দুই-তিন মাস দেরি করে! এই ব্যাপারটিকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?


বিক্রয়বন্ধু’র জবাব : প্রথমে বুঝতে হবে- টিএ ও ডিএ কী? টিএ মানে ট্রাভেল অ্যালাউন্স আর ডিএ মানে ডেইলি অ্যালাউন্স। একজন কর্মী (মূলত বিক্রয়কর্মীরা) কোম্পানির কাজে যেখানেই যাবেন, সেই নায্য যাতায়াত খরচ কোম্পানি বহন করতে বাধ্য (তবে পদমর্যাদা ও কাজের ধরন অনুযায়ী যানবাহনের প্রকারভেদ ও সর্বোচ্চ ব্যয়ের পরিমাণ নির্ধারিত থাকে); এটাকে টিএ বলে। এছাড়া প্রতিদিন অফিসে আসা-যাওয়া ও দুপুরে খাওয়া বাবদ প্রত্যেক কর্মীকে যে পরিমাণ হাতখরচ (পদমর্যাদা অনুযায়ী পূর্বনির্ধারিত) দেওয়া হয়, তাকে ডিএ বলে। সাধারণত টিএ variable আর ডিএ fixed হয়।

অনেক কোম্পানির এইচ.আর বেতন-ভাতা নিয়ে আলোচনার (Salary Negotiation) সময় মূল বেতনের সঙ্গে এই দু’টি খাতে প্রদত্ত অর্থ যোগ করে পারিশ্রমিকের পরিমাণটাকে বড় করে দেখানোর অপচেষ্টা করেন, যা অনুচিত। কেননা এই খাতে প্রাপ্ত অর্থ কোনো কর্মীই ভোগ করতে পারেন না, পুরোটাই কোম্পানির কাজে খরচ হয়ে যায়। সুতরাং এটাকে বেতনের অংশ হিসেবে প্রদর্শন/উল্লেখ করা সঠিক নয়।

কিছু কোম্পানি আবার বিক্রয়কর্মীদের মাসিক বিক্রয় লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হলে মনগড়া নিয়মে টিএ ও ডিএ আংশিক কর্তন করে রেখে দেয়- এটা আরো বড় অপরাধ। কেননা মার্কেট-এ বিক্রি হোক বা না হোক, টিএ ও ডিএ কিন্তু ঠিকই ব্যয় হয়ে গেছে (বিক্রয় লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হলে কি বাসভাড়া দেওয়া লাগে না? নাকি রিক্সাচালক বিনা ভাড়ায় বহন করে নিয়ে যাবেন)! সুতরাং টিএ ও ডিএ-’র কিছু অংশ কেটে রাখলে কর্মীকে তার বেতনের টাকা থেকে সেই ঘাটতি পূরণ করতে হয়। এই সংকট এড়াতে কিছু বিক্রয়কর্মী ইচ্ছেকৃতভাবে প্রকৃত খরচের চাইতে বেশি টাকার বিল দাখিল করে (অর্থাৎ মিথ্যাচারের আশ্রয় নেয়)। আমি মনে করি- এই অনিয়মের সূচনাকারী কোম্পানির ভুল টিএ ও ডিএ নীতিমালা। বিক্রয় লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের সঙ্গে অনুপ্রেরণামূলক ভাতার (incentive) সম্পর্ক থাকতে পারে, কিন্তু টিএ ও ডিএ কম-বেশি করার কোনো সুযোগ নেই। কোম্পানি অনিয়ম করলে কর্মীরাও পিঠ বাঁচাতে অনিয়মের আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়!

স্বনামধন্য বহুজাতিক কোম্পানিগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে মাসের শুরুতেই কর্মীর ব্যক্তিগত হিসাবে টিএ ও ডিএ বাবদ কিছু টাকা অগ্রিম দিয়ে রাখে (যেন টাকার অভাবে বিক্রয়কর্মী মার্কেট-এ যেতে পারছে না- এমন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির উদ্ভব না হয়) এবং মাস শেষে প্রকৃত বিল দাখিল করার পর সমন্বয় করে বাকি টাকাও অতি দ্রুত পরিশোধ করে দেওয়া হয়। এটাও একটা ভালো কোম্পানির অন্যতম বৈশিষ্ট্য বলতে পারেন। এ কারণে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর বিক্রয়কর্মীরা মার্কেট-এ সব সময় বেশি তৎপর থাকতে পারেন এবং বেশি বিক্রি করতে সক্ষম হন।

কিন্তু আমাদের দেশীয় কিছু কোম্পানি কর্মীদের টিএ ডিএ পরিশোধ নিয়ে রীতিমতো ‘ছ্যাঁচড়ামো’ করে! নানাভাবে ও বিচিত্র কৌশলে টিএ ডিএ কর্তনের অপচেষ্টা করেও ক্ষান্ত হয় না, শেষমেশ ইচ্ছেকৃতভাবে কয়েক মাস দেরিতে পরিশোধ করে। এমন কান্ড ঘটে অবশ্য হিসাব বিভাগে ঘাপটি মেরে বসে থাকা কিছু ‘অমানুষের’ জন্য। এরা মালিককে বোঝায়- কর্মীদের প্রাপ্য টাকাটা এখনই পরিশোধ না করে ব্যাংকে রেখে দুই মাস দেরিতে প্রদান করলে (যেহেতু কোনো বিলম্ব ফি বা জরিমানা দিতে হয় না) সুদ বাবদ কিছু টাকা আয় হবে! মালিকও তখন মওকা পেয়ে যায়! এর ফলে যে বিক্রয় প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং কর্মীদের মনোবল দুর্বল হয়ে যায়, সেদিকে কারো নজর নেই।

এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি সরব হওয়ার কথা বিক্রয় বিভাগের প্রধানের, কিন্তু হিসাব বিভাগের দাপটের সামনে (যেহেতু টাকা যার হাতে থাকে, তিনিই মালিকের কাছে লোক হয়ে যান; বিক্রয় বিভাগ যে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে মার্কেট থেকে টাকা তুলে এনে দেয়- সেই হুঁশ কারো থাকে না) তিনিও অসহায়! টিএ ও ডিএ দেরিতে পরিশোধ করার কারণে সাধারণত কেউ চাকরি ছাড়েন না। ফলে হিসাব বিভাগ অনায়াসে তাদের অনিয়মটাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে ফেলে!

মালিকপক্ষের বোঝা উচিত- হিসাব বিভাগের যে লোকগুলো কর্মী ও পাওনাদারের নায্য প্রাপ্তি দিতে ইচ্ছেকৃতভাবে দেরি/ফন্দি-ফিকির করে, তারা আসলে মালিকের প্রিয়পাত্র হতে চায়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কোম্পানির ভালো চায় না! এদের কারণেই অনেক কোম্পানি মাঝ পথে হোঁচট খায়। কোম্পানিকে বাঁচাতে চাইলে হিসাব বিভাগের এইসব ‘কুলাঙ্গার’-কে কোম্পানি থেকে ঘাড় ধরে বের করে দেওয়া উচিত। বিক্রয় বিভাগের লোকজনকেই এ ব্যাপারে সরব হতে হবে আর সরকার চাইলে শ্রম আইনে সংশ্লিষ্ট ধারা (টিএ ও ডিএ বিল দাখিলের সাতদিনের মধ্যে পরিশেধের বাধ্য-বাধকতা) যুক্ত করে বিক্রয়কর্মী তথা স্বল্প বেতনভোগী সাধারণ শ্রমিকের স্বার্থ সংরক্ষণে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারেন।

বিশ্বের নামীদামী কোম্পানিগুলো মেধাবী ছাত্র ও শ্রম-বাজারের সেরা পেশাজীবীদেরকে তাদের প্রতিষ্ঠানের প্রতি আকৃষ্ট করতে নানামুখী উদ্যোগ ও কৌশল প্রয়োগ করে থাকে (এর মানে শুধু বেতন বৃদ্ধি নয়, বরং আরো অনেক রকম সুযোগ-সুবিধা দিয়ে সেরা কর্মীদেরকে ধরে রাখার প্রচেষ্টা)। কারণ ওঁরা জানে- সেরা কর্মীদের মেধা ও হাত দিয়েই সেরা কিছু বেরুনো সম্ভব। ফলস্বরূপ কোম্পানিটি শত শত বছর দাপটের সঙ্গে টিকে থাকবে।

অন্যদিকে বাংলাদেশে এমন একটি কোম্পানিও নেই বা আজ পর্যন্ত তৈরি হয়নি- যারা এইভাবে চিন্তা করে, বাস্তবায়ন তো আরো দূরের কথা! সবাই সস্তায় ভালো কিছু খোঁজেন! ভালো পেশাজীবীদেরকে খুঁজে পেতে যে পরিমাণ বিনিয়োগ করা দরকার, সেদিকে কারো নজর নেই! ভালো পেশাজীবীদেরকে দীর্ঘদিন কোম্পানিতে ধরে রাখতেও অনেক কৌশল অবলম্বন করা লাগে। অথচ বেশিরভাগ বাংলাদেশী কোম্পানিতে বিভিন্ন একতরফা নিয়ম-নীতি চালু করে কর্মীদের উপর রীতিমতো অত্যাচার চালানো হয়! নানা নিয়মের বেড়াজালে তাঁদেরকে নায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করা হয় অথবা নানাভাবে হয়রানি করার পর পরিশোধ করা হয়।

মনে রাখতে হবে- যারা এসব করে, তারা কোনোদিনও ভালো কোম্পানি হয়ে উঠতে পারবে না! খালি বাংলাদেশ অধিক জনসংখ্যার দেশ বলে, চাকরিপ্রার্থীর সংখ্যা বেশি বলে আর আইনের কঠোর প্রয়োগ নেই বলে চাকরিজীবীদের উপর অনেক অত্যাচার করেও তারা পার পেয়ে যাচ্ছে...!

Post a Comment

0 Comments