লিখেছেন: মো: সদর আলী মোল্লা
গ্রাম ছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ
আমার মন ভুলায় রে,
ওরে তার সনে মন হাত বাড়িয়ে
লুটিয়ে যায় দুলায়রে,
আমার মন ভুলায় রে।
ও কোন বাঁকে কি ফল দেখাবে
কোনখানে কি দায় ঠেকাবে
কোথায় গিয়ে শেষ মিলে যে
ভেবে না কুলায় রে
আমার মন ভুলায় রে
গ্রাম ছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ
আমার মন ভুলায় রে...
প্রেম পবিত্র শিখা চিরদিন জ্বলে। স্বর্গ হতে আসে প্রেম স্বর্গে যায় চলে। একটি বাস্তব সত্য ঘটনা লিখলাম।
লজ্জা ঈমানের অঙ্গ। আমার ভীষণ লজ্জা হয় তারপরও লিখলাম।
প্রকৃতির লীলাভূমি রাঙ্গামাটি এর সৌন্দর্য বর্ণনা করা আমার সাধ্য নেই। তারপরও চেষ্টা করছি। আমি রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান থেকেছি। সবচেয়ে সুন্দর লেগেছে রাঙ্গামাটি। দুইবারে প্রায় নয় বছর থেকেছি। চট্টগ্রাম থেকে গাড়িতে উঠলেই কিছুদূর যাওয়ার পর শুরু হয় পাহাড়। গাড়ী পাহাড়ের গা ঘেঁষে যেতে থাকে। চারদিক ছোট-বড় পাহাড় আর পাহাড়। সমতল জেলার মানুষ প্রথম ভ্রমণ করলে গাড়ি উঁচু-নিচু ডানে-বাঁয়ে বাক নেয়ার সময় খিঁচুনি দিয়ে বমি করে কাপড় নষ্ট করে দেয়।
আমার স্ত্রীর কথা লিখব না। কারণ বললেই তার মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে যেত।
ফিরে আসি সৌন্দর্য বর্ণনায়। বড় বড় গাছ, সেগুন বাগান, মাঝে মাঝে পানি প্রবাহিত ছড়ার ওপর সেতু, সে এক মনোরম দৃশ্য। দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। অপলক দৃষ্টিতে যাত্রীরা তাকিয়ে থাকে। ২/৪ মাইল পর পর নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্প। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন দৃশ্য দেখতে দেখতে বেদবুনিয়া , ঘাগড়া, বনরুপা পার হয়ে গাড়ি পৌঁছে যায় রাঙ্গামাটি স্টেশনে।
জেলা শহর রাঙ্গামাটি অন্যান্য উপজেলার চেয়ে কিছুটা সমতল। বছরের অর্ধেক সময় চারদিক পানি থাকে। পরিষ্কার স্বচ্ছ পানি। অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। জেলা শহরে দেখার মতো বিভিন্ন জায়গা আছে। তার মধ্যে রিজার্ভ বাজার, বনরুপা, তবলছড়ি পর্যটন হোটেল, পর্যটন টিলাতেই পানির উপর ঝুলন্ত সেতু (এই টিলার পশ্চিম পাশে নিচে আশা থাকে যার গল্প বলব), ঝুলন্ত সেতুর নিকট থেকে পর্যটকদের নিয়ে ছোট ছোট বোর্ড শুভলং পর্যন্ত যাতায়াত করে। পানির উপর মনমুগ্ধকর দৃশ্য দেখে মন জুড়িয়ে যায় পর্যটকদের। রাঙ্গামাটি থেকে দুর্গম এলাকা যেমন ছোট হরিণা, হরিণা গুলশাখালী, রাজনগর, কাঁচালঙ্কা, মরিস্যা যেতে হলে রিজার্ভ বাজার থেকে জলযানের সাহায্য নিতে হয়। ছোট ছোট লঞ্চ, কান্ট্রি বোর্ড, স্পিডবোর্ড যাতায়াত করে। মারিশ্যা এর উদ্দেশ্যে রওনা দিলে বিশাল জলরাশি পার হয়ে যেতে রাস্তায় শুভলং পাহাড়ের কূল ঘেঁষে যেতে হয়। জলযান যখন শুভলং পাহাড়ের নিকট দিয়ে যায়, তখন মনে হয় এই বুঝি পাহাড় টা ভেঙে পড়ে। নৌকার গতি কমে যায়। স্বপ্নে বহুবার দেখেছি দৌড়াইতেছি, কিন্তু রাস্তা আগায়, না খুব কষ্ট পাই। পাহাড়টা কিন্তু যুগ যুগ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। এই জায়গায় নদী সরু, দুই পাশে ঝরনা কাছ থেকে দেখা যায়। চাকমাদের সুউচ্চ প্যাগোডা আছে, চারদিক ঘনবন, ছোট ছোট টিলা, মানুষ কোষা নৌকায় কাঠ সংগ্রহ করে, দেখতে দেখতে বোট পৌঁছে যায় লঙ্গদু বাজারে। এখানে একটা যাত্রা বিরতি দেয়া হয়। পনের-বিশ মিনিট যাত্রাবিরতি।
লঙ্গদু রাঙ্গামাটি জেলার একটি থানা। চারদিক পানিবেষ্টিত কমবেশি ১০০০ স্কয়ার এর একটি টিলা। চারদিক প্রায় ৬/৭ কিলোমিটার পর্যন্ত মানুষের নাগরিক চাহিদা মিটায় লঙ্গদু বাজার। যাত্রী নিয়ে ভোট চলছে উজানে ডানে বাক, বায়ে বাক, মাঝে মাঝে ধানক্ষেত, দূর পাহাড়ের দিকে তাকালে মনে হয় যেন পৃথিবীটা প্রাচীর ঘেরা। বটতলী স্টেশন পার হয়ে বোট চলে যায় মারিশ্যা (বটতলী গ্রাম আশার জন্মস্থান) মারিস্যাই জলযানের শেষ স্টেশন।
ডান পাশে স্কুল-কলেজ, উপজেলা, পোস্ট অফিস, বিডিআর ইউনিট। বাম পাশে কাঁচালঙ্কা বাজার। এরপর যাবো বটতলী, যেখানে প্রেমের সূচনা। তার আগে একটা কথা না বললেই নয়, গত চার বছর আগে শোহান (২৩) নামে একটি ছেলে আত্মহত্যা করে। জানা গেছে প্রেমিকার বাবা আজাহার আলী তার মেয়ে নিলু কে জোর করে অন্যত্র বিয়ে দিয়েছে। ছেলেটা দেখার মত, হাজারে একজন। শিক্ষিত কেন এমন হয়? সোহান তার বাবা মার একমাত্র পুত্র। প্রত্যেকের উচিত জীবনকে ভালোবাসা। আত্মহত্যা কোন সমস্যার সমাধান নয়। মৃত্যু কামনা করাও পাপ। ভালোবাসা খুব ওজন, সেই বুঝে যার ঘারে পড়ে। এ কোন জাতি, ধর্ম, বর্ণ বোঝে না। মানুষ ব্যালেন্স হারা হয়ে যায়। শিল্পী গান গেয়েছেন-
ডাক্তার যখন করবেন আমার ওপেন হার্ট সার্জারি,
দেখবেন হার্টের পাশে একটা মেয়ে রূপসীর বাড়ি।
ছুরি-চাকু সুই এর খোঁচা যেন না লাগে,
আমার বাঁচা মরা পরে, তার জীবনটা আগে গো
ডাক্তার ও ডাক্তার।
আসি মূল কথায়। বটতলী নিবাসী নুরু আহমদ তার চার ছেলে, তিন মেয়ে। এক অলি আহমদ, ডিসি অফিসের পিয়ন। বউ নিয়ে রাঙ্গামাটি থাকে। দ্বিতীয় সৈয়দ আহমদ। তৃতীয় জাহানা খাতুন। চার নজির আহমদ। পঞ্চম শবে মেরাজ খাতুন। ষষ্ঠ আয়েশা খাতুন
(গল্পের প্রধান) , সপ্তম লুৎফর আহমদ, মা-বাবাসহ সকলেই মারিশ্যা থাকে ১৯৯০ সাল থেকে। আশার বয়স আঠারো আর আমার পঁচিশ।দুজনে মুসলিম এবং অবিবাহিত। যথেষ্ট লজ্জা হয় তারপরও নিরুপায় হয়ে লিখলাম, যদি সোহান এর মত লোকদের কোন উপকারে আসে।
কাউন্টার ইন সার্জেন্ট অপারেশন, সিআইও ক্যাম্প, বটতলী।
আমি ওই ক্যাম্পে কর্মরত বিডিআর এর একজন সৈনিক।নূর আহম্মদের বাড়িটা ক্যাম্পের পাশেই। আমি ওই ক্যাম্পে প্রায় ছয় মাস অবস্থান করেছি। আশার সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে, কথাবার্তা হয়েছে। ঐবারে বাড়ি থেকে আসার সময় আমার মা বলেছেন, তোমার কোথাও কোন মেয়ে পছন্দ হলে আমার কোন আপত্তি নেই। কথাটা আমি সে সময় গুরুত্ব দেই নাই। আশার সাথে সাক্ষাৎ হওয়ার পর ওই কথাটা বারবার মনে পড়তে লাগলো। ভালোবাসার প্রথম স্তর ভালোলাগা। লক্ষণ খুব খারাপ, না দেখলে ভালো লাগে না। উঁকি ঝুঁকি বেড়ে গেছে। অন্য মানুষের নজরে পড়তেছি। আমার ব্যক্তিত্বের ওপর আঘাত আসতেছে। আশাকে বললাম আমি কি করতে পারি? আশা বলল গার্জিয়ান কে বলো। আমি সরাসরি আশার বাবাকে সালাম দিয়ে সব বলে দিলাম। আগে থেকেই তাদের পরিবারের সদস্যরা কিছুটা টের পেয়েছে। আসার বাবা বললেন রাঙ্গামাটি নিয়ে দিতে হবে। আমি বললাম দিবেন। ঘটনা মানুষের মাঝে জানাজানি হয়ে গেল। পাথর চুনায় পানি দিলে যে রকম বিস্ফোরণ হয়, ঐরকম কেহ পক্ষে ও বিপক্ষে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হলো।
কয়েক দিন পর আমাকে বড়তলী ক্যাম্প থেকে মারিশ্যা হেডকোয়ার্টারে পোস্টিং করা হলো। অধিনায়ক মেজর রফিকুল ইসলামকে আমি স্যালুট দিয়ে বললাম- স্যার আমার এই সমস্যা। স্যার খোলা মনের মানুষ, বললেন- যাও দেখি কি করা যায়। তদন্তে আমার বক্তব্য সত্যি প্রমাণিত হওয়ায়, হাবিলদার মেজর কে ডেকে বললেন- ওর জন্য একটা কোয়াটার ঠিক করো। এখান থেকে গাড়িতে বরযাত্রী যেয়ে বউ নিয়ে আসবে, ইউনিট খরচ বহন করবে। আমাকে দুই দিন ছুটি দেয়া হলো। আমি আমার মায়ের স্বাক্ষর নিয়ে দিলাম। মেয়েপক্ষের সম্মতি নিয়ে অনুমতির জন্য রাঙ্গামাটি লিখলেন। এই আমার ভাগ্যের চাকা উল্টা দিকে ঘুরল। তখন পর্যন্ত শান্তিচুক্তি হয়নাই। সেক্টর কমান্ডার কর্নেল নুর নবী সাহেব অনুমতি না দিয়ে বললেন- প্রবণতা বেড়ে যাবে। আমি সুস্থ থাকলে হয়তো বলতে পারতাম, প্রবনতার কি আছে? মানুষ বিয়ে তো একটাই করে। এমন নয় যে ছয় মাস পরে আমি বলব, আমাকে আরেকটা অনুমতি দেন। প্রচণ্ড আহত হলাম। আমার বাকশক্তি রহিত হয়ে গেল। আমি আশা কে যথাযোগ্য সম্মান দিয়ে নিতে পারলাম না। ঐদিকে আশার ভাইরা মনে করলো সেক্টর কমান্ডার নিষেধ করেছে এখানে আর বিয়ে দেয়া যাবে না। তাড়াতাড়ি মেয়ে অন্যত্র বিয়ে দিবে। ব্যাপারটা এরকম নয়, কর্নেল নূর নবী সাহেব আমার বিয়ে নিষেধ করার ক্ষমতা রাখেন না সে শুধু মারিশ্যা হইতে বটতলী সরকারি গাড়ি ও সম্পদ ব্যবহার নিষেধ করেছেন। এরপর বিয়ের প্রস্তাব আসলে আশা নিজেই বাতিল করেছে। এদিকে আমার অবস্থা খুব খারাপ।সহকর্মীরা সর্বক্ষণ আমাকে নিয়ে তামাশায় লিপ্ত। অবস্থা বেগতিক দেখে আমাকে ছুটি দেয়া হলো। আমি বাড়ি এসে পরের দিন একজন ভগ্নিপতি ও একজন মামাতো ভাইকে নিয়ে চলে গেলাম আশাদের বাড়িতে। আমি তখন খুব অসুস্থ, কিছু বলতে পারি নাই। আমার ভগ্নিপতি আশার ভাইকে বলেছে- এই মেয়েকে বিয়ে করলে আমি তার বোনকে রাখবো না। অথচ এই ভগ্নিপতি আমার সাহায্য ছাড়া অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ এ এক সপ্তাহ চলার ক্ষমতা নেই। মামাতো ভাই পাহাড়ের দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়ে চলে এলেন ঢাকায়। মানুষ কত অকৃতজ্ঞ। আমার বাবা নেই, আপন ভাই নেই, নিরুপায় হয়ে ওদেরকে সাথে নিয়েছি আমার টাকা খরচ করে। আর এখন আমার বিপক্ষে কথা বলেছে। মরার উপর খাড়ার ঘাঁ। আমি আগাতে পারলাম না, বরং পিছিয়ে গেলাম কিছুটা।
ঢাকায় পৌঁছে আর বলতে পারলাম না কি হলো। দুইদিন পর ঘুম ভাঙলে দেখি বিডিআর হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছি। আমার ব্রেনে আশা ছাড়া আর কিছুই নাই। সব সময় তাকেই ভাবি। একঘুম দেয়ার পর সুস্থ হয়ে গেলাম। কিন্তু ডাক্তার আমাকে ছাড়লো না। সব দিকে আমার প্রতিকূলতা। ৫/৬ মাস হাসপাতালে থাকলাম। এর মধ্যে অনেক কিছু ঘটে গেল। আশার বড় ভাই অলি আহম্মদ দুইবার আমার বাসায় আসলো, ভগ্নিপতি আসলো, আমার সাথে হাসপাতালে কথাবার্তা বললেন, ঘুরে ঘুরে আমার ব্যাপারে সবকিছু জানলেন, যাওয়ার সময় দুইবারই বলে গেলেন তাদের কোথাও কোনো আপত্তি নেই। দূরত্ব বাদে আর কোন আপত্তি থাকবে না, সেটা আমি আগুনে হাত দেয়ার পূর্বেই হিসাব করেছি।
৫/৬ মাস পর হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলাম। ঢাকা থেকে তিনজন একসাথে রাঙ্গামাটি গেলাম। বাকি দুই জনকে তবলছড়ি বাজার রেখে দশ মিনিটের জন্য আমি অলি আহমদের বাসায় গেলাম। প্রথম রোজার দিন আশার সাথে সাক্ষাৎ হলো। আশা বলল আমার জন্য বিয়ে ঠিক করেছে। আমি বললাম তুমি রাজি না থাকলে কেউ বিয়ে দিতে পারবেনা। ভালোবাসা যদি অপরাধ হয়, তবে দুজনেই সম অপরাধী। কাঁদবে তুমিও, যদি আমি কাঁদি। আমি অল্প কয়েকদিনের সময় চাই। মারিশ্যা গিয়ে ছুটির আবেদন করব। সর্বোচ্চ ৩০ দিন, তার বেশি নয়। এই কথাগুলি সুন্দর করে বলতে পারলাম না। ভাবীর কথায় আমার মাথাটা গরম হয়ে গেল, আবোল তাবোল কিছু বলে বের হয়ে গেলাম।
পরের দিন রাঙ্গামাটি থেকে মারিশ্যা চলে গেলাম। রাঙামাটি থেকে আমার মার কাছে চিঠি দিলাম, আশা খুব অসুবিধায় আছে। এখান থেকে ওকে নিয়ে যাও। মা চিঠি পেয়ে ভাবল রোজার কয়দিন গেলে, ঈদের পরদিন সব কাজ সেরে নিয়ে আসবো। আমি মারিশ্যা গিয়ে ছুটির আবেদন করলাম। নিষ্ঠুর পৃথিবী আমাকে আগাতে দিল না। ছুটির সিরিয়াল ঈদের পরের দিন। ওদিকে অলি আহমদের স্ত্রী আশার অসহায়ত্বের সুযোগে একজন ড্রাইভার এর সঙ্গে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিলো। ভাবির কৌশলের কাছে আশার সকল প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হলো। একহাজার টাকার নোটের পরিবর্তে দুই টাকার নোট। ওই পরম আত্মীয় ৮ বছরের একটি ছেলে, ছয় বছরের একটি মেয়ে আছে। ভাবি সেই পরম আত্মীয় কে দুই-তিন মাস আগে থেকে আশার পথে লেলিয়ে দিয়ে ছিল। এই ব্ল্যাকমেইলটা আশা বুঝতে পারে নাই। সকল জল্পনা কল্পনা শেষে ৯৯ তে আশা রান আউট হলো। ১ এর জন্য তার সেঞ্চুরি হলো না। আম্পায়ারের ভুল সিদ্ধান্তে আমি শূন্য রানে আউট হলাম। আত্মমর্যাদার জন্য থার্ড আম্পায়ারের আবেদন করলাম না।
ডিসকভারি চ্যানেলে দেখেছি বাঘ দৌড়াতে দৌড়াতে খুব কষ্ট করে শিকার ধরে পারিপার্শ্বিকতার জন্য শিকারটা হায়েনায় খায়। আশার ব্যাপারটা ওইরকমই হলো। কাচালং বাজার এর দোকানদার অবিবাহিত ছেলেটাকে বিয়ে করলে কষ্ট কম হতো। এখন প্রেমের কষ্ট, বাচ্চার কষ্ট, সব মানুষ এই সমালোচনাটাই বেশি করেছে। খুব সম্ভব পঁচিশ রমজান হবে, কাচালং বাজারে গিয়ে শুনলাম আশার বিয়ে হয়েছে। জীবনের সবচেয়ে বড় কষ্ট পেলাম।
অনেক সাধের ময়না আমার বাঁধন কেটে যায়,
মিছেই তোরে শিকল দিলাম রাঙা দুটি পায়।
জীবনটা দুর্বিসহ হয়ে গেল। মনে হলো আমি একটা প্রাণহীন প্লাস্টিক। ভারসাম্যহীন হয়ে গেলাম। বোধশক্তি নেই। অনেক কষ্ট বুকে নিয়ে রাঙ্গামাটি সেক্টরে এলাম। কেন এমন হলো? অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর। আমি পাথর হয়ে গেছি। ছুটি নিয়ে ঈদের পরদিন দশটায় সেক্টর থেকে বাহির হলাম। গেট থেকে সামনে অলি আহমদের বাসায় গেলাম। সেখানে আমি কিছু বলার আগেই অলি আহমদের স্ত্রী খল নায়িকার মত বলল আশা নিজেই চলে গেছে। আমার আর বুঝতে বাকি রইল না, মাচার নিচে কে রে, আমি তো আঙ্গুর না। সাথে সাথে ওখান থেকে বের হয়ে গেলাম। ভাবলাম এখানে আর আমার থাকার অধিকার নেই। ওই দিকে আমার মা, চাচাতো ভাইকে সাথে নিয়ে খুব ভোরের রাঙ্গামাটির উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে। ছোট্ট একটা ব্যাগ হাতে নিয়ে রাস্তা দিয়ে হাটতেছি আর ভাবতেছি লাফ দিয়ে গাড়ির নিচে পড়ে মরে যাই। আবার ভাবি, না মরে আহত হলে যন্ত্রণা আরও বেড়ে যাবে। মনে মনে অনেক কিছু কল্পনা করি আর ঢাকায় যাই। সে-ই প্রথম আসলো আবার সে-ই চলে গেল। মধ্যে থেকে আমাকে কষ্ট দিলো। যার জন্য আমি গভীর রাতে অচেতন অবস্থায় দোতলা থেকে লাভ দিয়ে নীচে পড়েছি। এক রাত্রে রুমের মধ্যে তালাবদ্ধ অবস্থায় ১২ লিটার এর এক বালতি পানি পান করেছি। মারিশ্যায় আমার আপন বলতে কেউ ছিল না। সেখানে বহু কিছু হয়ে গেছে। মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরেছি। সেই তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গেলে। আমার আর কি করার আছে? এই অনুভূতি আমি প্রকাশ করতে পারবো না। মনটা খুব কষ্ট করে নিয়ন্ত্রণে আনলাম।ব্যালেন্সহীন চলার জন্য রাস্তায় দু-তিনজনের ধমক খেয়েছি। ধমকি দিয়ে বলেছে ওই ব্যাটা নেশা করিস নাকি? ওভাবে হাটিস কেন? আমি সরি বলে চলে গেছি। সারারাত্র গাড়িতে বসে আছি। এক মিনিট ঘুম হয় নাই। ভাবতে কষ্ট হয় মানুষ কি করে এত কঠিন হতে পারে? সকাল আটটার দিকে বাসায় গিয়ে পৌছালাম। দেখলাম আমার বোনেরা দুজনে মিলে আমার ঘরটা ফুলে ফুলে সাজিয়ে রেখেছে।আমাকে একা দেখে অবাক হয়ে গেছে। আমি বললাম আশার অন্যত্র বিয়ে হয়েছে। ব্যাগটা পাশে রেখে খাটের উপর শুয়ে পড়লাম।
বন্ধু তুমি আইবারে বলে
আমি ঘর বান্ধিলাম নদীর কূলে রে বন্ধু
আইবার চাইয়া তুমি আইলানারে
আসা দেখলোনা, বাসর ঘর সাজানোর রইল। ওই দিকে আমার মা জননীর গাড়ি রাস্তায় আমার গাড়ির সাথে অবশ্যই ক্রস হয়েছে। কেউ কাউকে দেখি নাই। মিষ্টি নিয়ে পৌছে গেছে অলি আহমদের বাসায়। আমি জীবনে বহু বই পড়েছি, সিনেমা দেখেছি। আমি হয়তো ভালোভাবে লিখতে পারলাম না, তবে এ ঘটনার সাথে তুলনা করার মতো কিছু আমি দেখিনাই। ১৯৮৩ সালে লাইলি মজনু সিনেমা দেখেছি রংপুরে। চোখের পানিতে আমার জামার কিছু অংশ ভিজে ছিল। আমার এই ইতিহাস তার চেয়ে অনেক বেশি বেদনাদায়ক। আমার মা যখন শুনলেন আশার বিয়ে হয়েছে, তখন আর চোখের পানি রাখতে পারলেন না। হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। বললেন মেয়েটাকে একটু দেখতে চাই। কাছে পর্যটন টিলার পশ্চিম পার্শ্বে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই হাজির হল। আশা কাছে আসলে মা বললেন, এই তোমার প্রেম? তুমি আমার সহজ সরল ছেলেটার জীবনটা নষ্ট করলে। আশা বলল ওনাকে সুন্দরী মেয়ে বিয়ে করায় যেন। মা মিষ্টির প্যাকেট ওদেরকে দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন।
আমরা সচরাচর দেখতে পাই কোন কারণ ছাড়া রমজান মাসে বিয়ে হয় না। এই রমজান মাসে ঐতিহাসিক বদরের যুদ্ধ হয়েছে। তাছাড়া বিয়েতে পরিশ্রমের কাজ আছে। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপার আছে। তবে নিষেধ নেই। এই বিয়ের মূল কারণটা যে ব্ল্যাকমেইল তা আমি আগেই লিখেছি। পরের দিন সকালে মা ঢাকায় পৌছে ঘরে ঢুকেছে আর আমাকে বলতেছে কি আব্বা, কি হয়েছে? আমি বললাম না, কিছু হয় নাই। চিঠি পাওয়ার পর ২/৪ দিনের মধ্যে তুমি গেলে ওরা আর এ কাজটা করতে পারত না। সেই যাওয়া গেলে তবে সবকিছু শেষ করে। আশা আমার কলিজাটা ছিড়ে নিয়ে গেছে। সে একা, বাকিরা সব একজোট। তাদের মেয়েকে তারা দূরে বিয়ে দিবে না। তুমি গেলে আর কেহ সাহস পেত না। আশা সাহস পেত। আমার জন্য আশার জীবনটা নষ্ট হলো। কি জবাব দিব হাশরের মাঠে? ১২ বছর আগে বিবাহিত একজন লোকের সাথে তার বিবাহ হলো। দুই বাচ্চার বাবা। তার যৌবনের বারো আনা আগেই শেষ। চকচক করলেই সোনা হয় না। মালকা বানুর সাত ভাই,অভাগা মনু মিয়ার কেহ নাই। আমার মা যথেষ্ট চেষ্টা করেছে। আমার খালু আনোয়ার চৌধুরী ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন অফিসার ফোনে আশার সাথে কথা বলেছেন। আরও বহু কিছু হয়েছে। তারপরও নিষ্ঠুর পৃথিবী আশাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে গেল।
রমজান মাসের এক রাকাত নামাজ পড়লে সত্তর রাকাতের সওয়াব হয়। আমার মনে হয় রমজান মাস এলে আমার বুকের কষ্টটা সত্তর গুণ বেড়ে যায়। আশা এখন অবশ্যই নানি দাদি হয়েছে। কিন্তু আমার হৃদয় মাঝে সেই আঠারো বছরের কিশোরী, হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় বটতলীতে ঘুরে বেড়ায়। কসাই গরু-ছাগল জবেহ করতে ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করে, যাহাতে জীবের কষ্ট কম হয়। অলি আহম্মদ ১৯৮৯-১৯৯১ সাল, প্রায় তিন বছর যাবত আমার গলায় ভোঁতা, ধারহীন, দাও ঘষলো। অবশেষে শুভলং পাহাড় টা আমার বুকের উপর চাপা দিয়ে কেটে পড়ল। প্রথম রমজান শুরু করেছি লেখার কাজ, ৩০শে রমজান শেষ। রমজানে মানুষের অন্তর, চোখের জ্যোতি বেড়ে যায়। ৩০ বছর আগের ঘটনা। মনে হয় গত সপ্তাহে ঘটেছে। এরপর শুরু হলো আমাকে বিয়ে করানোর জন্য পাত্রী দেখা। আমার ভিতরটা ঘষে ঘষে জ্বলতে লাগল। আশা ছাড়া অন্য কারো কথা ভাবতে গেলে কষ্ট বেড়ে যায়। আমি ভাবতেই পারি না। আশার দেয়া সব শেষ চিঠিটা আমার পকেটে ছিল। তাতে একটা গানের কলি লেখা ছিল-
এক নদীরই উজান ভাটি
আমরা দুটি ধারা,
এক আকাশে জলে ওঠা
আমরা দুটি তারা
ও তুমি আমার আমি তোমার
প্রেমের পাগল পারা
চিঠিটা পকেটেই রাখতাম। একটু পর পর বের করে পড়তাম আর ভাবতাম, কি হলো ?কেন এমন হলো? আশার লেখাপড়া কম ছিল, বলেছিলাম বিয়ের পর কোয়ার্টার এ নিয়ে ঘাটতি পূরণ করে দিব। আশা ছিল, ভালোবাসা ছিল। আজ আশা নেই, ভালোবাসা নেই। এই সেই কৃষ্ণচূড়া যার তলে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ, হাতে হাত ব্যথা যেতো হারিয়ে, আজ এখানেই আমার আশার সমাধি। ব্যথা জানাবার কোন ভাষা নেই। সোহান এর কাছে এরকমই লেগেছিলো, যে রকম আমার কাছে লাগে। আমি বহু কষ্ট সহ্য করলাম। সে সহ্য করতে পারেনি, তাই আত্মহত্যা করেছে।
ডিজিটাল যুগ, মোবাইল কম্পিউটারে মানুষের চোখ ব্যস্ত থাকে। যুবক-যুবতী দুই হাত দিয়ে মোবাইল টিপে আর হাটে। প্রকৃতি দেখার সময় পায়না। এই যদি হয় অবস্থা, তবে আমার এই লেখা দেখবে কে? তাই অতি সংক্ষেপে মূল ঘটনাটুকুই লিখলাম। আমি তো প্রেমে পড়িনি, প্রেম আমার উপরে পড়েছে। আশা প্রথমেই বলতে পারতো মারিশ্যা আর ঢাকার দূরত্ব বেশি। আমি সামাল দিতে পারবোনা। আমাকে আগাইয়া দিয়া একদম শেষ মুহূর্তে এসে হাল ছেড়ে দিলো। জীবনটা আমার। আমার সিদ্ধান্তেই প্রাধান্য পাবে। আমার ভালো লাগে আম, আরেকজনের কথায় আমি তরমুজ খাব না। সে যতই ভালো হোক। সাভার এলাকায় একটি মেয়ে দেখেছি। বিয়ে পরে গায়ের রঙ শ্যামলা বলে মানলাম না। আশা বলেছে সুন্দরী মেয়ে বিয়ে করতে। বিয়ের আগ পর্যন্ত আমার মা কমবেশি একশত মেয়ে দেখেছে, কোন মেয়ের তরফ থেকে অসম্মতি আসে নাই।
চলে গেলাম দক্ষিণ অঞ্চল। যে অঞ্চলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান, পল্লী-কবি-জসিম-উদ্দিন, হাজী শরীয়তউল্লাহ সহ বহুবরেণ্য ব্যক্তিত্বের জন্মে ধন্য হয়েছে। বর্তমান পদ্মা সেতুর ৪ কিলোমিটার দক্ষিনে আমার জন্মস্থান। সুজলা সুফলা ফসলের মাঠ। বাতাসে ফুলের ঘ্রাণ নাকে লাগে। মন জুড়িয়ে যায়। খুব কষ্ট আশা দেখলো না। খালা, মামা, ফুফুর বাড়ি বেড়াতে বেড়াতে আমার মা পাত্রী দেখলো, যাকে আমি বিয়ে করেছি। নাম আনু, বাবার নাম মুন্সি আবদুল হামিদ। পাঁচ বোন, এক ভাই। অনু সবার বড়। আরেক পাত্রের সাথে বিয়ের কথা চলছিল। সব দিক থেকে বিয়ের জন্য চাপ। কিন্তু অনুর মনটা খুব খারাপ। এই মুহূর্তে আমি গিয়ে হাজির হলাম। আমি ও আমার ফুপাজান ওর সাথে দুই তিনটা কথা বলে ফুফুর বাড়ি চলে এলাম। ফুফুর বাড়ি থেকে ৫০০ গজ দূরে আনুর বাড়ি। সকলে জিজ্ঞাসা করতে লাগল পছন্দ হয়েছে কিনা। আমি বললাম পরে বলবো। আমার মা বলল ওকেই নেব। আমি আর কোনো আপত্তি রাখতে পারলাম না। কারণ আশা নেই।
২৭-০৮-১৯৯১ বিবাহ রেজিস্ট্রি হলো। পরের দিন চলে গেলাম রাঙ্গামাটি। সাতদিন পর ছুটি নিয়ে বৌ উঠিয়ে আসলাম। আবার রাঙ্গামাটি জয়েন করলাম। আমার আর মারিশ্যা যাওয়া হলো না। থেকে গেলাম রাঙ্গামাটি। পরিবারসহ বসবাসের আবেদন করলাম। এক মাস পর আমাকে বউ নিয়ে ইউনিটের বাহিরে থাকার অনুমতি দেয়া হলো। বুকের ভেতর অনেক কষ্ট। আশা আসলো না, তার জায়গায় আসলো অনু । হক সাহেবের বাসা ভাড়া নিলাম। অলি আহমদ এর বাসা থেকে আশিগজ পূর্বপাশে। পাকা রাস্তার কিনারায়। টিলার ওপর। দক্ষিণের জানালা খুলে তিনদিকে অনেকদূর পর্যন্ত দেখা যায়। ফ্যানের প্রয়োজন হয় নাই। পর্যটন টিলায় বাড়ি খেয়ে বাতাস সরাসরি আমার ঘরে ঢুকতো। প্রত্যেক ইউনিটের ৪/৫ জন করে লোক সেক্টরে থাকতো। তাদের কাজ হলো সকাল-সন্ধ্যা দুইবেলা ইউনিট এর সাথে যোগাযোগ করা। রিজার্ভ বাজারে কোন কাজ থাকলে তা করা।
আমি চাকরি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কাগজ-কলমের কাজটাই করেছি। সহপাঠীরাও আমাকে যথেষ্ট রিল্যাক্স রেখেছে। সরকারি কাজের বাজার করার জন্য তবলছড়ি, রিজার্ভ বাজার বেশি গিয়েছি। পাহাড়ি মুরগি ও লেকের মাছ যথেষ্ট সস্তা ছিল। অসুস্থ হলে সেক্টরে এমআই রুম আছে। চিকিৎসার ব্যাপারে যথেষ্ট যত্নবান। সেক্টরের ভিতরে এবং বাহিরে অনেকেই আমাকে চিনতো। কেউ কেউ মশকরা করে বলতো বউ আগেরটা সুন্দর না পরেরটা সুন্দর। আমি শুনেও না শোনার ভান করে চলে যেতাম। তুলনা করলে একই রকম, আশার চেয়ে আনু সামান্য একটু লম্বা, স্লিম, লেখাপড়া বেশি। আশার মনটা বেশি ভালো, এটা আমার সবচেয়ে বেশি পছন্দ। মানুষ নানা রকম মন্তব্য করেছে। আশা আমার বাসায় এসে আনুর সাথে অনেক কথা বলেছে। আমার অনেক প্রশংসা করেছে। এমনকি আমার সাথে ভাল ব্যবহার করতে বলেছে। কষ্ট ভিতরে চাপা রয়ে গেল।
এরপর আশার ভাই-বোন, মা আসছে, আর ওর সাথে কথা বলেছে। আমি একদিন বাসায় ঢুকে দেখি আশার মা। সালাম দিতেই হেসে অনুকে দেখিয়ে বলেছে এটা আমার মেয়ে। আমিও হেসে বললাম ঠিক আছে আপনি বেড়ান, আমি একটু বাহিরে যাব বলে চলে গেলাম। আনু সাধ্যমত আপ্যায়ন করেছে। আশার মা আমাকে অনেক ভালোবাসতেন। তার সাথে কথা বললে আমি ব্যালেন্স হারা হয়ে পড়বো ভেবে সরে গেলাম। মনে মনে ভাবলাম একবার বলি আম্মা আমার দোষটা কি। দেখলাম সে কষ্ট কম পায় নাই। তাই কিছু না বলে সরে গেলাম। এদিকে আশার শাশুড়ির মনে হল ওদের উপর আইয়ুবের মার্শাল-ল জারি করেছে।
গল্প শুনেছি আমেরিকাতে অবিবাহিত মেয়ে দুই তিনটা বাচ্চা নিয়ে রাস্তায় হাঁটে। আশাকে ঐরকমই দেখতাম আমার বাসার সামনে দিয়ে যাতায়াত করতে। আগের সেই হাস্যজ্জল চেহারাটা আর নেই। মুখটা মলিন হয়ে গেছে। বাচ্চা দুটো খুব সুন্দর। আনু মাঝে মাঝে আমাকে ডেকে দেখাতো। মনে প্রবল ইচ্ছা থাকলেও মুখে বলতাম দুর বাদ দাও। অনু স্বামী হিসেবে আমাকে ভালবাসে। আশার সমস্ত রক্ত-মাংস, পরমাত্মীয়র, কিন্তু রূহটা আমার। আশার বাসা আমার বাসার ১০০ গজ সামনে বায়ে চেপে পর্যটন টিলার নিচে। সেক্টর গেট থেকে দেখা যায়। অলি আহমদের বাসা ডানে। আমি কলিগদের বাসায় বেড়াতে যেতাম। সেক্টর এমআই রুমে যেতাম। সেক্টরে কোন অনুষ্ঠান হলে দেখতে যেতাম। আমি যে কবার দেখেছি আমার হারানোর ব্যথাটা তার চেহারায় পরিষ্কার ফুটে উঠেছে। প্রেম আমি একা করি নাই। এক হাতে তালি বাজে না। অলি আহম্মদ মানলো না, গলাটিপে হত্যা করলো। আশার চাহিদার চেয়ে আমার যোগ্যতা ঢের বেশি। ঢাকা থেকে সকালে বাসে উঠলে বিকালে মারিশ্যা।
প্রেসার, ডায়াবেটিসসহ কিছু রোগ আছে যা জীবনে সারেনা। ঔষধ খেয়ে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। তেমনি প্রেম রোগ সারেও না। আস্তে আস্তে বাড়ে। মানুষ এটাকে হেসে উড়িয়ে দেয়। আসলে এটা খুবই সিরিয়াস। কিন্তু নিয়ন্ত্রণের জন্য কোন ঔষধ নেই। লজ্জায় কেউ হয়তো প্রকাশ করে না। ভিতরে ভিতরে জ্বলে শেষ হয়। আমি খোলা দিলের মানুষ, লজ্জা ত্যাগ করে প্রকাশ করলাম। ভবিষ্যতে কোনো ঔষধ আবিষ্কার হলে পরবর্তী প্রজন্ম উপকৃত হবে। আমি না হয় নাইবা পেলাম। আমি যথেষ্ট লেখালেখি করি। কবিতা লিখি। ছাপাখানা থেকে বলা হয়েছে আমার এই লেখা বই ছাপানোর জন্য যথেষ্ট নয়। অত্যন্ত অপ্রতুল। তাই পৃষ্ঠা বৃদ্ধির জন্য একটু বাড়তি লিখলাম। তবে মিথ্যা কিছু লিখি নাই। যাহারা ইন্টারনেট দেখেন তারা www.totthomia.com লিখে সার্চ দিলে আমার লেখা দেখতে পাবেন। গান ইউটিউব এর জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, একটু সময় লাগবে। বইতে দুটি গান লিখলাম। মতামত থাকলে বলতে পারেন 01720342308 নাম্বারে।
রাজ সিংহাসন না ভাঙ্গিয়া, ভাঙলা কুড়েঘর।
যে ঘরে বসতি করে আমার এই অন্তর।
ঘর ভাঙল না, ভাঙল আমার বুকেরি পাঁজর।
আশা ছিল পাহাড় থেকে ময়না পাখি ধরে,
ভালোবাসার শিকল বেঁধে রাখিবো পিঞ্জরে।
আমার বুকের উপর ঠোকর দিয়া,
পাখিটি গেল উড়িয়া,
পাইলাম না খবর।
আশার বাসা ভেঙে গেল সর্বনাশা ঝড়ে,
আনু এসে ঠিক করিল অনেক যত্ন করে।
বলে হাসি হাসি ভালোবাসি
তোমার সাথেই পরবাসী
রাখিয়ো নজর।
রাঙা বউ চোখ রাঙ্গিয়ে আমার দিকে চায়
এক সেকেন্ডে মনটা আমার রাঙ্গামাটি যায়
রাঙ্গামাটির রঙ এর ছিটা লাগছে আমার গায়
সেথায় আছে আশা মনি
তোমরা তাকে চিনো নি
মন চুরি করিয়া সেজে দিয়াছে পালানি
তার বিরহ মনটা আমার এখনো কাঁদায়
ও কোথায় থাকবে পালাইয়া
বাহির করবো খুঁজিয়া
প্রেম করার সময় কি তুমি দেখো নাই ভাবিয়া
মরণ বাচন থাকবো আমি তোমার অপেক্ষায়
ঐ আমি সাজাইয়া বাসর
তাকে দিয়েছি খবর
সে বলে কিভাবে যাব ঢাকার শহর?
আধা রাস্তায় এসে শেষে হাল ছাড়িয়া দেয়
আর বাড়াবোনা আমার স্ত্রীর চূড়ান্ত সময় এসে গেলো। ঢাকা থেকে আমার মা চলে আসলে। সরকারি অ্যাম্বুলেন্স এ রাঙ্গামাটি হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। ২৩-০১-১৯৯৩ বেলা ১২.৪০ এ আমার বড় বাবু জন্ম নিল। ক্ষতবিক্ষত মনটা কিছুটা শৃঙ্খলা ফিরে আসলো। মনে কষ্ট রয়ে গেছে, অলি আহমেদ আমার আশা মনির সাথে গরু ছাগলের মত ব্যবহার করেছে। দেখতে দেখতে আঠারো মাস শেষ হয়ে গেল। আমার ইউনিট চলে গেল যশোর। আমি যশোর গিয়ে আবার পারমিশন নিলাম। দুই বছর পর বউ-বাচ্চা ঢাকায় রেখে দিলাম। চার বছর পর ১৯৯৭ সালে আমার ইউনিট আবার রাঙ্গামাটি গেল। আমি সাথে আছি। কেউ হয়তো ভেবে থাকতে পারে চলে গেছে, ভুলে গেছে। না ভুলি নাই, ভুলবোনা। সেবার আর মারিশ্যা নয়, গুলশাখালী, রাজনগর থাকলাম। সেক্টর আর.পি পোস্ট থেকে আমার অনেক কলিগ আমার নাম ধরে পানির ওপার থেকে ডাকলে, কেউ টলমল করে তাকাতো। আমি বলতাম ওভাবে ডাকলে অন্য কেউ ক্ষেপে যাবে। মনে অনেক কষ্ট তাই রাঙ্গামাটি থাকলাম না। চলে গেলাম উপরের ক্যাম্পে গুলশাখালী রাজনগর গুরু সাতং, নোয়াপাড়া, জিরার খামার, দেবাসরী, দোকান ঘাট, চরুয়াখালি, মসজিদবাড়ী চোষে বেড়ালাম।
প্রত্যেকবার ছুটিতে আসা যাওয়ার সময় সেক্টর গেট থেকে তবলছড়ি বাজার পর্যন্ত এক কিলোমিটার রাস্তা অতিক্রম করতে যেয়ে কি রকম কষ্ট হতো, সেটা বোঝানোর ক্ষমতা আমার নেই। খালি হাতে হাঁটলেও মনে হতো পঞ্চাশ কেজি ওজন বহন করতেছি। মনে হতো এই বুঝি পেছন থেকে কেউ আমার জামা টেনে ধরল। বাতাসটা ভার, আমার বুকে বাজতো, স্বপ্নে হাঁটার মতো পা চলত না। আমি দ্রুত হাঁটা হাটতাম, রাস্তা আগাতো কম। শরীরটা যেন ভয়ে ফালাফালা ভাব। মাঝে মাঝে ঝাকি দিয়ে পশমগুলি দাঁড়িয়ে যেত। মনে হতো কেউ জোরে শব্দ করলে আমি চমকে মাটিতে পড়ে যাব। সেক্টর থেকে বাহির হতে হাতের ডানপাশে নীল পানিতে পানকৌড়ি পাখি তেলাপিয়া মাছ গিলে খাচ্ছে দেখেছি। বাম পার্শ্বে কবরস্থান। আমি হাঁটছি উত্তর দিক, হৃদয় বীণে সেই সুর বাজে।
এখনো কি প্রথম সকাল হলে
স্নানটি সেরে পূজার ফুল তুলে।
পূজার ছলে আমারই কথা ভাবো,
বসে ঠাকুর ঘরে।
জানতে ইচ্ছে করে।
তুমি কি সেই আগের মতই আছো?
নাকি অনেকখানি বদলে গেছো?
জানতে ইচ্ছে করে
খুব জানতে ইচ্ছে করে।
0 Comments