বছর কয়েক আগের কথা। বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে এক ভদ্রলোক হোটেলে খাইতে গেছিল। ভেতরের সাজসজ্জা ছিল একদমই সাদামাটা। চেয়ার-টেবিল গুলা ছিল কাঠের। কিন্তু নামডাক সেইরকম। ব্ল্যাকবোর্ডে চক দিয়া লেখা মেন্যু। তালিকায় মাত্র কয়েকটা খাবার আইটেম লেখা ছিল। ভদ্রলোক কারণ জানতে চাইলে ম্যানেজার বলল, তারা তাদের দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় দেখছে, মেন্যুর তালিকা অনেক বড় করলেও অধিকাংশ লোকজন ঘুইরাফিরা মাত্র কয়েকটা খাবারই পছন্দ করে। সেই জন্যই তাঁরা মেন্যুটা ছোট কইরা বানাইছে। ভদ্রলোক ভাবছিল, জাইনা হোক বা না জাইনা হোক ম্যানেজমেন্টের দারুণ এক তত্ত্ব কিন্তু এই হোটেল মালিক ব্যবহার করতেছে।
এই তত্ত্বটা হইলো ‘৮০/২০’ তত্ত্ব। অর্থনীতি, ম্যানেজমেন্ট, চলতি ঘটনা, এমনকি আমগো দৈনন্দিন জীবনের অনেক কিছুই, শতবর্ষ পুরানা এই ৮০/২০ তত্ত্ব দিয়া ব্যাখ্যা করা যায়। তত্ত্বটার মানে হইলো ৮০ ভাগ ফলাফল আসে ২০ ভাগ চেষ্টার ফলে।
সেলস লাইফ হোক বা পৃথিবীর যেকোন লাইফেই হোক, এই জিনিস টা জানা আপনার জন্য বাধ্যতামূলক। তাই লেখাটা মন দিয়া দেখার কোন বিকল্প নাই। তো বন্ধুরা হতে সময় নিয়া চলেন শুরু করি।
চলেন সহজ উদারণ দিয়া শুরু করি। ধরেন আপনে একটা ব্যবসা করেন। আপনার কাস্টমার সংখ্যা অনেক। এই রুলস অনুযায়ী, কোনো ব্যবসায় মোট বেচাকেনার প্রায় ৮০ ভাগ আসে ২০ ভাগ কাস্টমারের কাছ থেকে বা মাত্র ২০ ভাগ পণ্য থেকে। আপনার অফিসেও হয়তো খেয়াল করলে দেখবেন মোট কাজের ৮০ ভাগ করতেছে মাত্র ২০ ভাগ লোকজন। অফিসে ৮০ ভাগ ঝামেলার কেন্দ্রতেও দেখবেন সেই ২০ ভাগ লোকজনই। বা মনে করেন ,আপনার ১০টা জামা আছে, কিন্তু দেখবেন, ঘুইরাফিরা আপনি বেশিরভাগ সময়েই দুইটা বা তিনটা জামা ব্যবহার করেন। মনে হইবো যেন আপনি ওই জামাগুলার সাথে বিয়ে বইছেন।
বিশ্বজুইরা অনেক সিনেমা বানানো হয় প্রতিবছর। কিন্তু হিসাব করলে দেখবেন, সিনেমার মোট আয়ের ৮০ ভাগই আসতেছে মাত্র ২০ ভাগ পরিচালকের সিনেমা থেকে।
যাইহোক, অর্থনীতিবিদ ভিলফ্রেডো প্যারিটো নামের এক ইতালিয়ান ভদ্রলোক এই তত্ত্বের জনক সরি জননী, সরি জনক।
কোনো এক গ্রীষ্ম কালে বাড়ির বাগানে মটরশুঁটির উৎপাদন দেইখা তিনি অনেক আশ্চর্য হইছিলেন। মোট ফলনের প্রায় ৮০ ভাগই আসছে মাত্র ২০ ভাগ মটরশুঁটিগাছ থেকে। এই অনুপাত অন্য কোনো ক্ষেত্রে কাজে লাগে কি না, সেইটা দেখার জন্য ভদ্রলোক গবেষণা শুরু করেন। ১৮৯৬ সালে প্যারিটো সাহেব প্রমাণ করেন, ইতালির মোট জনসংখ্যার মাত্র ২০ ভাগ লোকজন দেশটার ৮০ ভাগ জমির মালিক।
আমেরিকার অর্থনীতিবিদ এডওয়ার্ড উলফ ২০০৭ সালে দেখাইছেন, আমেরিকার ২০ ভাগ লোকজনই দেশটার মোট সম্পদের ৮৫ ভাগের মালিক। ২০২২ সালে প্যারিস থেকে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হইছে, মাত্র ১০ ভাগ ব্যক্তি পৃথিবীর ৭৬ ভাগ সম্পদের নিয়ন্ত্রণ করে। বিভিন্ন দেশ ও শহরে দেখা গেছে, ৮০ ভাগ অপরাধ করে মাত্র ২০ ভাগ অপরাধী। বেশ কয়েক বছর আগে মাইক্রোসফট জানাইছিল, তাদের সফটওয়্যারের ৮০ ভাগ সমস্যার কেন্দ্রে আছে ২০ ভাগ কোড। গত বছরে আমেরিকায় বেসবলের টুর্নামেন্টগুলায় ৮৫ ভাগ জয়ের পেছনে অবদান রাখছে মাত্র ১৫ ভাগ খেলোয়াড়। ক্রিকেট আর ফুটবলেও একই চিত্র পাওয়া যায়।
এই স্ক্রিপ্ট যিনি লিখছেন, উনি পেশাগত জীবনের একটা বড় সময় ম্যানেজমেন্ট কনসালট্যান্ট ছিলেন। ইউরোপ, আমেরিকার ওষুধ কোম্পানিগুলার বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সমাধানে উনার ডাক পড়ত। এই রকমই একটা প্রজেক্টে একবার উনার ডাক পড়ল। সেইটা আবার বিশ্বের অন্যতম একটা ওষুধ কোম্পানি। বিভিন্ন দেশে এই কোম্পানির গবেষণাগার আছে। সমস্যা হইলো হাতে গোনা কয়েকটা গবেষণাগারে নিয়মিত নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিত। চাকরি পরিবর্তনের হার সেই জায়গা গুলাতে অন্য জায়গার থেকে বেশি ছিল। একই ধরনের গবেষণার জন্য অন্য জায়গার থেকে সেই গবেষণাগারের খরচও ছিল বেশি। আর সেই জায়গা গুলাতে গবেষণার যন্ত্রপাতিও নষ্ট হইত বেশি।
১০ বছরের পুরানা সব ডেটা অ্যানালাইসিস করার পর তারা তো অবাক। ওই কোম্পানির গবেষণাসংক্রান্ত সাফলতার প্রায় ৭৪ ভাগ আসছে ওই ২৮ ভাগ গবেষণাগার থেকা। সেই ২৮ ভাগ গবেষণাগারের বিজ্ঞানীরা অন্য গবেষণাগার গুলার বিজ্ঞানী গো থেকে অনেক বেশি একটিভ ছিল। মাথাপিছু প্রজেক্টের সংখ্যাও বেশি ছিল। জনবলও অন্য জায়গা থেকে তুলনায় বেশি। প্রজেক্ট বেশি হওয়ায় বাজেটও বেশি লাগত। আর কাজ বেশি জন্য যন্ত্রপাতিও নষ্ট হইত বেশি।
প্যারিটোর এই সূত্র সেলস মার্কেটিংয়েও অনেকভাবে কাজে লাগানো যায়। সেলস প্রফেশনে সবারই ছোট, মাঝারি বা বড় অনেক ধরনের টার্গেট থাকে। টার্গেট গুলা থেকা মাত্র গুটি কয়েক বাইছা নেন, যেগুলা আপনি সত্যি সত্যি পূরণ করতে চান, যেগুলা না হইলে চলবেই না। এইবার আপনার পুরা সময়ের ৮০ ভাগ ওই টার্গেট পূরণ করার জন্য কাজে লাগান। সফল হওয়ার সম্ভাবনা দেখবেন অনেক বাইরা গেছে।
আপনার অনেক বন্ধু আছে। কিন্তু আপনি কি খেয়াল করছেন অল্প কয়জন বন্ধুর লগে মিশতেই আপনার বেশি ভাল্লাগে। বিপদে তারা আপনার পাশে থাকে বা তাদের কাছ থেকে আপনি কিছু শিখতে পারেন। অনেকের লগে মেশা কমায়া এই অল্প কয়জন বন্ধুর লগে সম্পর্ক আরও গাঢ় করার চেষ্টা করেন। আরও বেশি সময় দেন। পেশাগত জীবনে বিভিন্ন মানুষের লগে নেটওয়ার্ক করেন। সময় আর সফলতার সাথে সাথে এই নেটওয়ার্ক গুলাও বাড়াইতে থাকেন। এই নেটওয়ার্কের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ২০ ভাগ মানুষরে বাইছা নিয়া তাগো লগে সম্পর্ক বাড়ানোর জন্য আরো বেশি সময় দেন। দেখবেন চারদিকে শুধু জয়জয়কার।
কিছুদিন আগে আমেরিকার এক গবেষণায় আসছে, একজন মানুষ দৈনিক গড়ে চার ঘণ্টা ফোনের মধ্যে সময় দেয়। ৮০/২০ রুলস ব্যবহার করলে দেখা যায়, এই চার ঘণ্টার হয়তো মাত্র ২০ ভাগ সময় মানে ৪৮ মিনিটের মতো আপনে প্রয়োজনীয় কাজে ব্যয় করেন। তার মানে আপনি চাইলেই আরো তিন ঘণ্টা বেশি সময় অন্য প্রয়োজনীয় কাজে ব্যয় করতে পারেন।
আপনি হয়তো চাকরি খুঁজতাছেন। একাধিক কোম্পানিতে সিভি পাঠাইছেন। কয়েকটা ইন্টারভিউতে শেষ ধাপে গেছেন। অনেকগুলো থেকে কোনো সাড়াই আসে নাই। আশাহত না হইয়া যেই কোম্পানিগুলা থেকে আপনারে ইন্টারভিউতে ডাকছে, সেই ধরনের কোম্পানিগুলা বা একই ধরনের চাকরির গুলা বেশি আবেদন করেন। দেখবেন ফলাফল আসবে।
ব্যবসার অনেক সমস্যা খুঁজতে বা সমাধান করতে ৮০/২০ রুলস প্রয়োগ করা যাইতে পারে।
যেইকোনো কোম্পানির ৮০ ভাগ সমস্যার মূলে আছে মাত্র ২০ ভাগ সমস্যা। এই ২০ ভাগ সমস্যা মোকাবেলায় ৮০ ভাগ সময় বরাদ্দ দেওয়া উচিত। যেইসব প্রোডাক্ট থেকে ব্যবসার মোট সেলসের ৮০ ভাগ আসে, সেইসব প্রডাক্টের বিক্রি কীভাবে বাড়ানো যায়, সেইটা নিয়া ভাবেন। কষ্টমারের অসন্তুষ্টির দিকে নজর দেন। দেখবেন অধিকাংশ ক্ষেত্রে কাস্টমাররা একই ধরনের কারণের জন্য অসন্তুষ্ট থাকে। মার্কেটিংয়ের বিভিন্ন উপায় পরীক্ষার করেন। দেখবেন মাত্র গুটিকয়েক মার্কেটিং সফল হইছে।
বইলা রাখা ভালো, এই তত্ত্ব কিন্তু সব জায়গায় নাও সমান ভাবে কাজ করতে পারে। তাই সতর্কতাও রাইখেন।
তো আজ আমরা আলোচনা করলাম প্যারিটো প্রিন্সিপাল বা ৮০/২০ তত্ত্ব নিয়া। এই তত্ত্বের আগাগোড়া আর কিভাবে এই তত্ত্ব সেলস মার্কেটিং বা জীবনের নানান কাজে প্লাস ভুগিযুগী যেই যেই জায়গায় কাজে লাগে তা নিয়া। লেখাটি ভালো লাগলে চ্যানেল টা সাবস্ক্রাইব কইরেন আর পাশে থাকা ঘন্টাটা বাজায়া দিয়েন। আর পাশে থাইকেন তথ্যের সাথে, জ্ঞানের সাথে। থাইকেন তথ্য মিয়ার সাথে।
তথ্য মিয়া - তথ্য এখন পকেটে পকেটে। ধন্যবাদ সবাইকে।
ওহ! আরেকটা কথা এই স্ক্রিপ্ট টা আমি রিরাইট করছি ● ড. সুব্রত বোস স্যারের প্রথম আলোতে লেখা একটা প্রবন্ধ থেকে। স্যার একজন প্রবাসী বাংলাদেশি প্লাস বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বিভাগের গ্লোবাল ভাইস প্রেসিডেন্ট। স্যারকে অসংখ্য ধন্যবাদ এত সুন্দর গবেষনাধর্মী একটা লেখা আমাদের সাথে শেয়ার করার জন্য। তো সবাই ভালো থাকবেন। কথা হবে পরের ব্লগে। টাটা।
0 Comments